আজ ২১ জুন। ২০১১ সালের এই দিনে স্যার চলে গেছেন। স্যারের পরে ম্যাডামও চলে গেলেন ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর। অনেক দিন পরে স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম আমার গুরুগৃহ তেমনই রয়েছে। উপরের ফ্লোরে থাকেন তার বড় মেয়ে প্রফেসর হুমায়রা আখতার ও তার পরিবার। উল্লেখ্য, স্যারের এটি বড় মেয়ে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অণুুজীব বিজ্ঞানের শিক্ষক। অনেক কথা হলো স্যারের ছেলে-মেয়ে, বৌমা ও নাতি-নাতনীদের সাথে।

কত স্মৃতি নিয়ে সবার আলোচনা। স্যার তার শিক্ষা ও গবেষণা শেষে অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং এসেই যখন বাড়িতে যান তখন নাকি স্যার অত্যন্ত কঠিন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং তা কাটিয়ে ওঠা আর স্যারের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্যার যখন তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় পৌঁছে যান তখনো তার মাকে না দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। স্যার জীবনভর একটি দৃশ্য দেখে আসছেন বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই বাড়ির সামনে রাস্তার একটি পাশে মাকে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষায়রত। আপনজনদের কাছে অস্থিরতার সাথে জানতে চান মা কোথায়? তারা তাকে বুঝিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে যান এবং স্যার জানতে পারেন স্যারের মা এবং বাবা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। সে সময় টেলিফোনব্যবস্থা এমন ছিল না যে, দ্রুত জানানো যায় এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুটা হলেও তাদের সন্তান কিংবা আপনজনকে কিছুটা হলেও শান্ত করা যায়। ভেবেছেন ঠিক এ সময় স্যারকে জানানো ঠিক হবে না, যখন তার দেশে ফেরার সময় হয়ে এলো। স্যার এই প্রকার আঘাতের কারণেই কি না জানি না, সব সময় ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, অপ্রাসঙ্গিকভাবেও মা-বাবার কথা তুলে বলতেন, আল্লাহর পরেই মা-বাবার স্থান, তাদের সাথে ‘উহ’ শব্দটিও উচ্চারণ করবে না।

সন্তানদের কাছ থেকে জানতে পারলাম স্যারের বাড়ি যাওয়ার তারিখ পড়লে স্যারের মা এক সপ্তাহ আগে থেকে ভালো-মন্দ যা কিছু রেঁধেছেন তা জ্বাল দিয়ে দিয়ে শিকায় তুলে রাখতেন সন্তানের জন্য। আর আজ আমরা দেখতে পাই মা-বাবা বুড়ো হলে কত কত সন্তান তাদের কাউকে কাউকে বিদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। কেউ লোকলজ্জার ভয়ে মসজিদের আশপাশে, রাস্তার ধারে, জঙ্গলে কিংবা রাতের অন্ধকারে হাটবাজারে, গাছতলায় রেখে আসে।

স্যারের ক্লাসে পড়া শুনতে শুনতে চলে যেতাম অস্ট্রেলিয়া, বার্ডস অব প্যারাডাইস চোখে দেখতে পেতাম। চলে যেতাম আমাজান জঙ্গলে। স্যার গবেষণার ব্যাপারটা আল্লাহর ইবাদত বলেই বুঝতেন। ছাত্রছাত্রীদের বলতেন স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন ছাড়া মানুষের মঙ্গল সম্ভব নয়। পরিবেশের সুস্থতার কথা বেশি আর কেউ বলেছেন বলে আমার জানা নেই। বন্যপ্রাণী বাঁচলে বন বাঁচবে, বন বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, মানুষ সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে শুধুই প্রকৃতির কাছ থেকে।

প্রতি বছর গাছ লাগানোর মৌসুম এলে স্যারের কথা স্মরণ না করে পারি না আমরা। প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের হাতে গাছের চারা বিতরণের সময় স্যারের হাত দিয়েই বিতরণ শুরু করতাম আমরা। দেশজ ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা মিশিয়ে কেন গাছ লাগাতে হবে তার গুরুত্ব স্যারের কাছ থেকে জেনেছে দেশ এবং এই পদ্ধতিই অনুসরণ করছে সরকার। আমরা এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। স্যারের দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম তথা বন্যপ্রাণীর প্রতি মমতা দেশকে অনেকটাই সজাগ করেছে। স্যার মাতৃভূমি নিয়ে, মাতৃভাষা নিয়ে, প্রকৃতির স্বাস্থ্য নিয়ে যত চিন্তা করেছেন এমনটা অন্য কাউকে করতে দেখেছি বলে মনে হয় না।

তার গবেষণালব্ধ বই ‘নজরুলের গানে ও কবিতায় পাখিদের আনাগোনা’ অত্যন্ত উন্নত স্তরের একটি গবেষণা সম্ভার। স্যারের আর একটি বই ‘পশ্চিমা বিশ্বকে তৃতীয় বিশে^র কাছে ক্ষমা চাইতে হবে’। ওরা আমাদের সব দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে বলেই আজ বিশ^জুড়ে এই রুদ্ররূপ। প্রকৃতি কোনো দেশের বাউন্ডারি মানে না, এই জ্ঞানটুকু তাদের ছিল না। এখনো নেই বলেই ক্ষতি পূরণ নিয়ে চলছে টালবাহানা।

স্যারের লেখা প্রায় ২০টি বই, ৮০টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ এবং প্রায় ৪০০ জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দেশকে তথা বিশ্বকে উপকৃত করেছে। তিনি অর্জন করেন এGlobal 500 Roll of Honour, দেশের শীর্ষ জাতীয় পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এবং রাষ্ট্রীয় শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইভ কনজারভেশন’। এ ছাড়াও অন্যান্য বহু পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটেছে প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন স্যারের বেলায়।

আমরা স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, আল্লাহর দরবারে দোয়া করি।

লেখক : পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়